
বর্তমান সময়ে ফেসবুক শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং এটি এখন ইনকাম করার অন্যতম বড় একটি প্ল্যাটফর্ম। আমি নিজে দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুক পেজ পরিচালনা করছি এবং নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি— ফেসবুক এখন এক বিশাল কর্মক্ষেত্র যেখানে জ্ঞান, সময় ও সৃজনশীলতা থাকলেই উপার্জন সম্ভব।
১/ ফেসবুক পেজ কি?
ফেসবুক পেজ মূলত এমন একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল, যা ব্যবসা, সংগঠন, ব্র্যান্ড বা ব্যক্তিগত প্রচারের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। আগে যেখানে শুধুমাত্র আইডি দিয়ে যোগাযোগ করা যেত, এখন পেজের মাধ্যমেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে একত্রে যুক্ত করা যায়। আমি যখন প্রথম ফেসবুক পেজ খুলেছিলাম, তখন মনিটাইজেশনের নিয়ম ছিল অত্যন্ত কঠিন— ১০ হাজার ফলোয়ার, ৫টি ভিডিওতে নির্দিষ্ট ভিউ এবং গত দুই মাসে ৬০,০০০ মিনিট ওয়াচ টাইম। এই সব শর্ত পূরণ করে আমি একাধিক পেজ মনিটাইজেশন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকের পলিসি অনেকটাই সহজ হয়েছে। বর্তমানে শুধু পেজ নয়, এমনকি ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি দিয়েও ইনকাম করা সম্ভব। আমার নিজের একটি ফেসবুক আইডি রিসেন্টলি “Content Monetization” অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়াও ফেসবুক স্টার, প্রমোশন এবং ব্র্যান্ড সহযোগিতার মাধ্যমেও ইনকাম করা যায়।
সবচেয়ে জনপ্রিয় ইনকাম মডেল হলো “কনটেন্ট মনিটাইজেশন”। অর্থাৎ আপনি যদি নিয়মিত ভিডিও আপলোড করেন এবং সেগুলো দর্শকেরা দেখে, তাহলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আপনি আয় করতে পারবেন।
২/ ফেসবুক পেজ খোলার নিয়ম
ফেসবুক পেজ খোলা এখন অনেক সহজ। আগে একে কঠিন মনে হতো, কিন্তু বর্তমানে ফেসবুক তার ইউজার ইন্টারফেসকে আরও সহজ ও ব্যবহারবান্ধব করেছে। আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লগইন করে উপরের মেনু থেকে “Create Page” অপশনে গিয়ে আপনি মুহূর্তেই পেজ খুলে ফেলতে পারেন।
পেজ তৈরি করার সময় একটি প্রফেশনাল নাম, উপযুক্ত ক্যাটাগরি (যেমন Entertainment, Education, Business ইত্যাদি), এবং প্রোফাইল ও কভার ছবি যুক্ত করতে হয়। আমি যখন প্রথম পেজ খুলেছিলাম, নাম নির্বাচনেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম, কারণ নামটি আপনার ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি বহন করে।
পেজ খোলার পর নিয়মিত পোস্ট করা, দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, এবং ফলোয়ার বাড়ানো হলো মূল কাজ। বর্তমানে ফেসবুক এমন অ্যালগরিদম ব্যবহার করছে যা সক্রিয় পেজগুলোকেই বেশি রিচ দেয়।
৩/ ফেসবুক পেজ থেকে ইনকাম
ফেসবুক পেজ থেকে আয়ের নানা উপায় আছে, তবে আমার অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো “কনটেন্ট মনিটাইজেশন” এবং “স্টার ইনকাম”। কনটেন্ট মনিটাইজেশনে আপনার ভিডিওতে বিজ্ঞাপন যুক্ত হয়, এবং দর্শক সেই বিজ্ঞাপন দেখলেই আপনি আয় পান। আমি নিজে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিকবার ইনকাম করেছি।
অন্যদিকে, “স্টার” হলো এক ধরনের ডিজিটাল গিফট যা দর্শকেরা আপনার ভিডিওতে পাঠায়। এই স্টারগুলো পরে অর্থে রূপান্তর করা যায়। অনেক সময় দর্শকেরা প্রশংসাসূচক মন্তব্যের সঙ্গে স্টার পাঠায়— যা খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক।
এছাড়া ব্র্যান্ড প্রমোশন, প্রোডাক্ট মার্কেটিং, অ্যাফিলিয়েট লিংক ইত্যাদির মাধ্যমেও ইনকাম করা যায়। আমি নিজে কিছু প্রোডাক্টের রিভিউ করে ভালো আয় করতে পেরেছি।
৪/ ফেসবুক আইডি থেকে ইনকাম
২০২৫ সালে এসে ফেসবুক আইডিকেও পেজের মতোই ইনকামযোগ্য করে তুলেছে মেটা। অর্থাৎ এখন কনটেন্ট মনিটাইজেশন, স্টার এবং প্রমোশন— সবকিছুই আইডিতেও প্রযোজ্য। আমি সম্প্রতি আমার মূল ফেসবুক আইডিতে কনটেন্ট মনিটাইজেশন অ্যাক্টিভ করেছি এবং সেখানে নিয়মিত ভিডিও আপলোড করছি।
আগে ইনকাম করতে হলে শুধু পেজ ছিল একমাত্র উপায়, কিন্তু এখন আইডিও আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে নতুন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য সুযোগ আরও বেড়েছে।
সংক্ষেপে বললে— ফেসবুক এখন একে একে আইডি এবং পেজের মধ্যকার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিচ্ছে। উভয়ই এখন সমানভাবে ইনকামযোগ্য।
৫/ ফেসবুক ব্যবহার বিধি
বর্তমানে ফেসবুকের ইউজার সংখ্যা তিন বিলিয়নেরও বেশি। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নতুন একাউন্ট তৈরি হচ্ছে। আমি নিজেও এখন পাঁচটি ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করি, যেগুলোর প্রত্যেকটি আলাদা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে খোলা।
ফেসবুকের জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে যে, এখন এটি শুধু যোগাযোগের নয়, বরং ব্যবসা, শিক্ষা ও বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। তাই একাউন্ট ব্যবহারের সময় নিয়মনীতি মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফেসবুকের গাইডলাইন অনুযায়ী অশালীন, কপিরাইট বা স্প্যাম কনটেন্ট পোস্ট করা নিষিদ্ধ। নিয়ম মেনে ব্যবহার করলে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ থাকে।
৬/ ফেসবুক সিকিউরিটি
ফেসবুকের সিকিউরিটি নিয়ে সবসময়ই ইউজারদের মধ্যে উদ্বেগ থাকে। আমার নিজেরও কয়েকবার ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। তবে মেটা এখন তাদের সিকিউরিটি সিস্টেমকে অনেক উন্নত করেছে।
বর্তমানে “Meta Verified” নামের একটি প্রিমিয়াম সেবা চালু হয়েছে, যেখানে টাকার বিনিময়ে আপনি আপনার একাউন্টে নীল ব্যাজ (ভেরিফিকেশন) পেতে পারেন। এর ফলে একাউন্ট হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায় এবং ফেসবুক আপনার একাউন্টকে বিশেষ সুরক্ষা দেয়।
তবে প্রিমিয়াম ব্যাজ ছাড়াও নিয়মিত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন, টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন চালু রাখা এবং সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক না করা জরুরি।
৭/ ফেসবুক সিকিউরিটির ক্ষেত্রে আত্ম সচেতনতা
একজন ব্যবহারকারীর আত্মসচেতনতা ফেসবুক সিকিউরিটির প্রায় ৯৫% নির্ভর করে। আপনি যদি সেই ইমেইল বা মোবাইল নাম্বারটি প্রকাশ্যে রাখেন যেটি দিয়ে একাউন্ট খুলেছেন, তাহলে হ্যাকাররা সহজেই পাসওয়ার্ড রিসেট করে এক্সেস নিতে পারে।
আমি নিজে বর্তমানে আমার সমস্ত ফেসবুক একাউন্টে যুক্ত জিমেইল ও মোবাইল নম্বর হাইড করে রেখেছি। এছাড়াও টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন (2FA) চালু রেখেছি— যার ফলে কেউ পাসওয়ার্ড জানলেও লগইন করতে পারে না, কারণ ভেরিফিকেশন কোড আমার মোবাইলে আসে।
সুতরাং ফেসবুক ব্যবহার করতে হলে নিজের তথ্য গোপন রাখা, সিকিউরিটি কোড সক্রিয় রাখা এবং সন্দেহজনক ডিভাইসে লগইন না করাই নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি।
৮/ ফেসবুক বিজনেস
বর্তমানে ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইন বিজনেস করা খুবই সহজ ও জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। আপনার যদি কোন প্রোডাক্ট থাকে, সেটির বিজ্ঞাপন (Ad Run) করে টার্গেটেড অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে বিক্রি করা যায়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে চায়না থেকে কিছু পাওয়ার ব্যাংক আমদানি করে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন চালিয়ে বিক্রি করেছি। ফলাফল ছিল চমৎকার— স্বল্প বাজেটে ভালো প্রফিট পেয়েছি।
ফেসবুক বিজনেস ম্যানেজার, মেটা অ্যাডস সেন্টার ইত্যাদি টুল ব্যবহার করে আপনি অল্প সময়েই একটি প্রফেশনাল অনলাইন ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন।
৯/ ফেসবুক ভাইরাল টিপস
২০২৫ সালের ফেসবুক অ্যালগরিদম অনুযায়ী, আপনি যদি পোস্টে বা ভিডিওর ক্যাপশনে কোন লিংক যুক্ত করেন, তাহলে সেই পোস্টের রিচ অনেক কমে যাবে। অন্যদিকে, শুধুমাত্র টেক্সট বা ভিডিও পোস্ট করলে তার রিচ অনেকগুণ বেড়ে যায়।
অর্থাৎ ফেসবুক চায় আপনি তার প্ল্যাটফর্মেই থাকুন, বাইরের সাইটে না যান। তাই লিংকসহ পোস্ট কখনোই ভাইরাল হয় না। আমি নিজে রিসেন্টলি এই নিয়ম মেনে চলছি এবং দেখেছি, দুই ঘণ্টায় আমার একটি পোস্টে ১৩ হাজারেরও বেশি লাইক এসেছে।
তাই ফেসবুকে অর্গানিক রিচ পেতে হলে— নিয়মিত পোস্ট করতে হবে, মানসম্মত কনটেন্ট দিতে হবে এবং কোন লিংক যুক্ত করা যাবে না। ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেই আপনার পেজ বা আইডি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
✍️ উপসংহার
সবশেষে বলা যায়— ফেসবুক এখন শুধুমাত্র একটি সোশ্যাল মিডিয়া নয়, বরং এটি একটি ক্যারিয়ার গড়ার প্ল্যাটফর্ম। আপনি যদি নিয়মিত কাজ করেন, কনটেন্ট তৈরি করেন এবং সঠিক নীতিমালা মেনে চলেন, তাহলে ফেসবুকের মাধ্যমে ঘরে বসেই ভালো ইনকাম করা সম্ভব।
Leave a Reply